বাংলাদেশে মোট দেশজ আয় পরিমাপ পদ্ধতি আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়। এই পাঠটি “এনসিটিবি মাধ্যমিক ৯ম ও ১০ম শ্রেণির অর্থনীতি” এর “জাতীয় আয় ও এর পরিমাপ” ষষ্ঠ অধ্যায় এর অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশে মোট দেশজ আয় পরিমাপ পদ্ধতি
বাংলাদেশে জিডিপি গণনার দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো । পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রতি বছর চলতি বাজার মূল্য ও স্থির মূল্যে দ্রব্য ও সেবার মূল্য পরিমাপ করে জিডিপি গণনা করে থাকে । এসব হিসাব করতে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে থাকে । বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো উৎপাদন পদ্ধতি ও ব্যয় পদ্ধতি ব্যবহার করে জিডিপি ও জিএনআই গণনা করে । উৎপাদন পদ্ধতিতে মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) পরিমাপের জন্য অর্থনীতিকে মোট ১৫টি প্রধান খাতে বিভক্ত করা হয় । খাতসমূহ হচ্ছে—
১. কৃষি ও বনজ সম্পদ : কৃষি দেশজ উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ খাত ধরাবাঁধাভাবে হিসাব করা কঠিন । বাংলাদেশে GDP গণনা করতে এ খাতকে তিনটি উপখাতে বিভক্ত করা হয় ।
(ক) শস্য ও শাকসবজি : এখাতে দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ চলতি পাইকারি বাজারমূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে হিসাব করা হয়। যেমন- ২০১২-১৩ সালে এখাতে উৎপাদন ছিল ১,০৬,৭৯৪ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ১,২৬,১২১ কোটি টাকা ।
খ) প্রাণিসম্পদ : এ খাতের হিসাবও চলতি বাজার মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ হিসাব করা হয় । প্রাণি সম্পদ উপখাতে ২০১২-১৩ সময়ে দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৫,৩৫৯ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ সালে ২৯,৮৮৫ কোটি টাকা।
(গ) বনজ সম্পদ : বন খাতের উপকরণের তথ্যের অভাবে মোট উৎপাদন হতে ৩% মূল্য বাদ দিয়ে যা থাকে, তাকে মূল্য সংযুক্তি হিসেবে বিবেচনা করে GDP বের করা হয়। ২০১২-১৩ সালে দেশজ উৎপাদন ছিল ১৬,৬০৫ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ২০,৪৯৪ কোটি টাকা ।
১. মৎস্য সম্পদ : অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক উৎস থেকে মোট মৎস্য আহরণের প্রেক্ষিতে মোট দেশজ উৎপাদনের হিসাব করা হয়। এখাতে ২০১২-১৩ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৩৬,৯৯৫ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ৪৭,৫৮১ কোটি টাকা ।
২. খনিজ ও খনন : শিল্প খাতের মধ্যে খনিজ ও খননকে আলাদা খাত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এ খাতে (ক) প্রাকৃতিক গ্যাস ও অপরিশোধিত তেল এবং (খ) অন্যান্য খনিজ সম্পদ ও খনন বিষয়ের উৎপাদিত পণ্যের বাজারমূল্যের হিসাব করা হয়। এসব খাতের হিসাব দেশজ উৎপাদনের দিক থেকে গণনা করা হয় । ২০১২-১৩ সালে এ খাতে আয় হয় ১৯,৪৬১ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে হিসাব করা হয়েছিল ২৩,৮৭৬ কোটি টাকা ।
8. শিল্প (ম্যানুফেকচারিং): বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন গণনার ক্ষেত্রে সকল শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করে মোট দেশজ উৎপাদন বের করা হয় । বাংলাদেশে শিল্প উৎপাদনের পরিমাণ ২০১২-১৩ সালে ১,৯৭,১২৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে (ক) বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পের দেশজ উৎপাদন ১,৫৮,৪৪৮ কোটি টাকা এবং (খ) ক্ষুদ্রায়তন শিল্প খাতে ৩৮,৬৭৯ কোটি টাকা । ২০১৪-১৫ সালে শিল্প উৎপাদন বৃহৎ ও মাঝারি শিল্প উৎপাদন এবং ক্ষুদ্র শিল্প উৎপাদন যথাক্রমে ২,৫৪,৪৮৩ কোটি টাকা; ২,০৫,৯৯২ কোটি টাকা এবং ৪৮,৪৯১ কোটি টাকা ।
৫. পাইকারি ও খুচরা বিপণন : এ হিসাবে পণ্যের পাইকারি মূল্য হিসাবের মাধ্যমে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ গণনা করা হয়। ২০১২-১৩ সালে ১,৫৪,৫৭৯ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ১,৯২,৫৮৫ কোটি টাকা হিসাব করা হয় ।
৬. বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানিসম্পদ : এ খাতে সেবা সরবরাহ মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে মোট দেশজ উৎপাদন মূল্য হিসাব করা হয় । বাংলাদেশের জন্য এই খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ । সরকারের পাশাপাশি এ খাতসমূহ বেসরকারিভাবেও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। ২০১২-১৩ সালে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৬৩৮১ কোটি টাকা । এর মধ্যে (ক) বিদ্যুৎ উপখাতে ১২১৬৮ কোটি টাকা। (খ) গ্যাস উপখাতে ৩৪৪৮ কোটি টাকা এবং (গ) পানি উপখাতে ৭৬৬ কোটি টাকা আয় হয় । ২০১৪-১৫ সালে এ তিনটি খাতের সমষ্টি ১৯,৮৬৮ কোটি টাকা ।
৭. নির্মাণ : নির্মাণ খাত থেকে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ হিসাব করা হয় ব্যক্তি, নির্মাণ প্রতিষ্ঠান, ভোক্তা এবং সরকারের প্রাপ্ত তথ্য থেকে । বাস্তবে এ খাত থেকে যে পরিমাণ আয় হিসাব হওয়ার কথা তার তুলনায় কম হয় । কারণ চলতি বাজারমূল্য সরকার প্রদত্ত বেঁধে দেয়া মূল্য থেকে বেশি । অথচ সরকারি বেঁধে দেয়া মূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে মোট দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ হিসাব করা হয় । ২০১২-১৩ সালে এ খাত থেকে আয় হয় ৮২৪৩২ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ১০৮৪৮৪ কোটি টাকা ।
৮. হোটেল ও রেস্তোরাঁ : এই খাতের মোট দেশজ উৎপাদনের বিষয়টি উৎপন্ন দ্রব্যের ও সেবার বিক্রয় মূল্যের প্রেক্ষিতে হিসাব করা হয়। ২০১২-১৩ সালে এ খাত থেকে আয় হয় ১১২৬৩ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সময়ে ১৪,৯২৮ কোটি টাকা ।

৯. পরিবহণ, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ : এ খাত দেশজ আয় গণনার একটি বড় খাত। এ খাতটির বড় অংশ বেসরকারি হাতে ন্যাস্ত আছে। তারপরও ২০১২-১৩ সালে স্থুল আয় হয়েছিল মোট ১,২৪,২৮১ কোটি টাকা যার মধ্যে- (ক) স্থল পথ পরিবহন উপখাতে ৯২১৮৩ কোটি টাকা, (খ) পানি পথ পরিবহন উপখাতে ৭৬৪৯ কোটি টাকা, (গ) আকাশ পথ পরিবহন উপখাতে ১০৪৭ কোটি টাকা, (ঘ) সহযোগী পরিবহন সেবা ও সংরক্ষণ উপখাতে ৬০০১ কোটি টাকা এবং (ঙ) ডাক ও তার যোগাযোগ খাতে ১৭৪০০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ সময়ে পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ খাতে মোট আয় হয় ১,৫০,০২৫ কোটি টাকা ।
১০. আর্থিক প্রাতিষ্ঠানিক সেবা : এ খাতের হিসাব করা হয় সেবা থেকে প্রাপ্ত মূল্যের ভিত্তিতে ২০১২-১৩ সময়ে এ খাত থেকে দেশজ উৎপাদন মূল্যের পরিমাণ ছিল ৪২২৩৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে— (ক) ব্যাংক উপখাতে ৩৪৭২৭ কোটি টাকা; (খ) বিমা উপখাতে ৪৯২০ কোটি টাকা এবং (গ) অন্যান্য খাত থেকে আয় হয় ২৫৯০ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট ৫৫,৭৬১ কোটি টাকা আয় হয়। উপখাত অনুযায়ী এ আয় যথাক্রমে ৪৬৬৪৪, ৫৯৩৮ ও ৩১৮০ কোটি টাকা ।
১১. রিয়েল এস্টেট, ভাড়া ও অন্যান্য ব্যবসা : এ খাত থেকে দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ হিসাব করা হয় সেবা থেকে প্রাপ্ত আয়ের পরিমাপের ভিত্তিতে। ২০১২-১৩ সালে এ খাত হতে প্রাপ্ত দেশজ আয় ছিল ৭৮৮২০ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সময়ে ১০,০৬০ কোটি টাকা ।
১২. লোকপ্রশাসন ও প্রতিরক্ষা : এ খাত থেকে প্রাপ্ত দেশজ আয়ের হিসাব করা হয় মূলত ব্যয়ের দিক থেকে । ২০১২-১৩ সালে দেশজ উৎপাদন ছিল ৩৭৬৭৮ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ৫০,৬৭৪ কোটি টাকা ।
১৩. শিক্ষা : বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে মোট দেশজ উৎপাদন হিসাব করা হয় ব্যয়ের দিক থেকে। ২০১২-১৩ সালে এ খাতে দেশজ উৎপাদন ছিল ২৮৪২৯ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সালে ৩৭,৬২৪ কোটি টাকা ।
১৪. স্বাস্থ্য ও সামাজিক সেবা : স্বাস্থ্য ও সেবা খাতের বিষয়টি হিসাব করা হয় ব্যয় পদ্ধতিতে । এক্ষেত্রে মোট দেশজ উৎপাদন ব্যয় ২০১২-১৩ সময়ে হয়েছিল ২৩৮৬৮ কোটি টাকা এবং ২০১৪-১৫ সময়ে ব্যয় ৩০,১৩৫ কোটি টাকা ।

১৫. কমিউনিটি, সামাজিক ও ব্যক্তিগত সেবা : এ খাতে ব্যয়ের দিক থেকে মোট দেশজ উৎপাদণ গণনা করা হয়। ২০১২-১৩ সালে এ খাত থেকে ১৩৮৯৫২ কোটি টাকা ব্যয় গণনা করা হয় এবং ২০১৪-১৫ বছরে ১,৭৬,৪০২ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল ।
আরও পড়ূনঃ