আজকে আমরা সোনার বাংলা : অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত সম্পর্কে আলোচনা করবো। এটি জনাব আকবর আলি খান এর বহুল-পঠিত একটি প্রবন্ধ। আকবর আলি খান (১৯৪৪ – ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২) ছিলেন একজন বাংলাদেশি সরকারি আমলা, অর্থনীতিবিদ এবং শিক্ষাবিদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি হবিগঞ্জের মহুকুমা প্রশাসক বা এসডিও ছিলেন এবং যুদ্ধকালীন সক্রিয়ভাবে মুজিবনগর সরকারের সাথে কাজ করেন।

সোনার বাংলা : অর্থনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত
“আমার সোনার বাংলা” রবীন্দ্রনাথ কখন লিখেছেন তা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে ১৮৯৭ সালে নাটোরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে “সোনার বাংলা” প্রথম গাওয়া হয়েছিল। ঐতিহাসিক তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্ত কুমার পালের সিদ্ধান্ত হল যে, গানটি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ১৯০৫ সালে রচিত হয়।
পালের অনুমান সঠিক হলে চুয়াল্লিশ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ গানটি লিখেছিলেন। আশি বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ মারা যান। জন্মভূমির প্রতি যে প্রগাঢ় ভালবাসা ও নিবিড় মমত্ববোধ এই মধুর সঙ্গীতে সঞ্চারিত তা রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অটুট ছিল কি না সে সম্পর্কে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
১৯০৫ সালে একটি পত্রে তিনি লিখেছেন, “এবারকার যে আন্দোলনে দেশের হৃদয় জাগ্রত হইয়াছে তাহাকে যাহারা ছলনা করিয়া বিদ্রূপ করিতে পারে তাহারা শয়তানের চেলা। সারা জীবনই শয়তানের চেলারা রবীন্দ্রনাথকে জ্বালিয়েছে। ঈর্ষা, লোকনিন্দা ও দলাদলির অচলায়তনে অবরুদ্ধ রবীন্দ্রনাথের কাছে অনেক সময় মনে হয়েছে যে, গ্রামের দুষ্ট ছেলেরা “কুকুরের ল্যাজে ঝুমঝুমি বেঁধে” যেভাবে তাড়িয়ে বেড়ায় তেমনি তাঁকেও সারা জীবন নিগৃহীত করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্যা মৈত্রেয়ী দেবী জানাচ্ছেন যে, দুঃখ করে রবীন্দ্রনাথ নাকি বলেছেন, “একদিন লিখেছিলুম ‘সার্থক জন্ম মাগো জন্মেছি এ দেশে’।
মরার আগে নিজের হাতে এ লাইনটি কেটে দিয়ে যাব”। ভাগ্যিস বিধাতা রবীন্দ্রনাথকে অল্পের জন্য পঞ্চাশের মন্বন্তর থেকে রেহাই দিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুর মাত্র দুবছরের মধ্যে তাঁর “সোনার বাংলাতে” অনাহারে ত্রিশ লাখ লোক মারা যায়। পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় বেঁচে থাকলে তাঁর দুর্ভাগা দেশকে কি অভিধায় কবিগুরু আখ্যায়িত করতেন আজ তা অনুমান করা কঠিন।
রবীন্দ্রনাথ “সোনার বাংলা” বাগধারাতে ‘সোনার’ বিশেষণটি কি অর্থে যোগ করেছেন। সে সম্পর্কে পণ্ডিতদের মনে কোন সন্দেহ নেই। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন সোনার বাংলার অর্থ হল । “স্বর্ণপ্রসূ বঙ্গভূমি, সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বঙ্গভূমি। রবীন্দ্রনাথের আগেই এ অর্থে “সোনার বাংলা” বাগধারাটির প্রচলন দেখা যায়। ১৮৬২ সালে প্রকাশিত “হুতোম পেঁচার নকসায়” উল্লেখ রয়েছে “হ্যানো সোনার বাংলা খান, পোড়াল নীল হনুমানে।”

নীল বিদ্রোহের লোকগীতির একটি চরণে বলা হয়েছে, “নীল বাঁদরে সোনার বাংলা করে ছারখার।” পণ্ডিতদের যুক্তি অকাট্য। তবু গানটি পাঠ করে পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। গানটিতে মূলত বাংলাদেশের ঐশ্বর্য বা উৎপাদনশীলতা তুলে ধরা হয়নি (কবি অবশ্য অগ্রহায়ণের “ভরা ক্ষেতের” কথা বলেছেন। কিন্তু সব সময়েই যদি ফসলের ছড়াছড়ি থাকত তবে মায়ের “বদন খানি মলিন” হত না। এবং কবিকেও নয়ন জলে ভাসতে হত না।
গানটিতে রয়েছে বাংলাদেশের অনুপম নিসর্গের বন্দনা। সোনা শব্দটির একটি অর্থ হল অতি আদরের ধন (যথা সোনা ভাই আমার, সোনার ছেলে)। মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, “সোনার বাংলা” কি কবিগুরু “অতি প্রিয় বাংলা” অর্থে ব্যবহার করেছেন? ভাষা বিশেষজ্ঞগণ আমার সঙ্গে একমত হবেন না। তাঁদের মতে “সোনার বাংলা” শুধু কবির রূপক নয়, “সোনার বাংলা” ইতিহাসের বাস্তবতা।
ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুসারে প্রাক-ব্রিটিশ বাংলা ছিল পার্থিব স্বাচ্ছন্দ্যে উচ্ছলিত অমরাবতী। ঐতিহাসিকরা বিশ্বাস করেন যে, ব্রিটিশরা জয় করার আগে এ দেশ শুধু অপূর্ব রূপময়ই ছিল না, অমিত ঐশ্বর্যশালীও ছিল। ইংরাজ শাসনের আগে এ দেশে কোন দুর্ভিক্ষ ঘটেনি। এখানে দ্রব্যমূল্য ছিল অত্যন্ত সস্তা। তাই সাধারণত জীবনযাত্রার মান ছিল অত্যন্ত উন্নত। অসাধারণ প্রাচুর্যের এ দেশে দারিদ্র্য ছিল অজানা। বাংলাদেশ তাই মোগল আমলে “জান্নাত-আবাদ” (স্বর্গপুরী) ও “জান্নাত-আল-বিলাদ” (জনপদসমূহের স্বর্গ) নামে পরিচিত ছিল।
সোনার বাংলা সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অবশ্য মূলধারার অর্থনৈতিক তত্ত্বের সঙ্গে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন যে, প্রাক-শিল্প-বিপ্লব সমাজে এ ধরনের নিরবচ্ছিন্ন আর্থিক সমৃদ্ধি মোটেও সম্ভব নয়। তাত্ত্বিক ও প্রকরণগত মতবিরোধ সত্ত্বেও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রাক-শিল্প-বিপ্লব অর্থনীতি সম্পর্কে বিস্ময়কর ঐকমতা রয়েছে। এ সম্পর্কে ধ্রুপদী, নব্যধ্রুপদী, কেইনসীয় (Keynesian) ও মার্কসীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদদের মধ্যে কোন দ্বিমত নেই।
ধ্রুপদী (classical) অর্থনীতিবিদদের মতে প্রাক-শিল্প-বিপ্লব সমাজ ছিল ম্যালথুসীয় ফাঁদে (Malthusian trap) বন্দী। রিকার্ডোর মজুরি সম্পর্কে অমোঘ বিধির (iron law) বক্তব্য হল, শ্রমিকদের মজুরির হার দীর্ঘ মেয়াদে বেঁচে থাকার জন্য যে ন্যূনতম মজুরির প্রয়োজন (subsistence wage) তার চেয়ে বেশি থাকতে পারে না। মজুরি বাড়লে জনসংখ্যা বেড়ে যাবে। কিন্তু এ ধরনের সমাজে দীর্ঘস্থায়ী ভিত্তিতে মজুরির হার অথবা জীবনযাত্রার মান উড়ু রাখা সম্ভব নয়।
অর্থনীতিবিদ ম্যালঘুসের বিশ্লেষণে প্রাক-শিল্প-বিপ্লব অর্থনীতিতে ভারসাম্য রক্ষা করত দুর্ভিক্ষ। এ ধরনের অর্থনীতিতে মজুরির হার বেড়ে গেলেই জনসংখ্যা বেড়ে যেত, এর পরিণামে মজুরি আবার নেমে আসত এবং এক পর্যায়ে আয়ের স্বল্পতার ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। দুর্ভিক্ষে জনসংখ্যা কমে গেলে আবার মজুরি বেড়ে যেত। এমনি করে চক্রাকারে মজুরির হার বাড়ত, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে মজুরির হার বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম মজুরির পর্যায়ে থাকত। যদিও নৰাধ্ৰুপদী ও কেইনসীয় অর্থনীতিবিদগণ আজকের অর্থনীতিতে ধ্রুপদী
অর্থনীতির সূত্রসমূহ অচল গণ্য করেন, তবু প্রাক্-শিল্প-বিপ্লব সমাজ সম্পর্কে ধ্রুপদী বিশ্লেষণ তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য। নব্যধ্রুপদী ধারার দু’জন অর্থনৈতিক ঐতিহাসিক এ ধরনের সমাজ সম্পর্কে লিখেছেন। যদি আমরা মানুষের দীর্ঘ ইতিহাসের চিত্র তুলে ধরি এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের অর্থনৈতিক জীবন আধুনিক মানদণ্ডে বিচার করি, তা হলে দেখতে পাব যে জীবন ছিল বিরামহীন দুর্দশা দুর্দশার যুগকে কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে এবং সে সব যুগকে গ্রাম্য সারল্যের স্বর্ণযুগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সে সব যুগ স্বর্ণযুগ ছিল না।
বিংশ শতকের সেরা অর্থনীতিবিদ কেইনসও একই ধরনের মত পোষণ করতেন। কেইনস লিখেছেন : “প্রাচীনতম সময় যখন থেকে লিখিত প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, ধরুন, খৃষ্ট জন্মের দু’হাজার বছর আগে থেকে আঠারো শতকের শুরু পর্যন্ত পৃথিবীর সভ্যতার কেন্দ্রসমূহে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের কোন বড় পরিবর্তন হয়নি। উঠানামা হয়েছে নিশ্চয়ই। প্লেগ, দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধও দেখা দিয়েছে। কখনও এসেছে সোনালী বিরতি। কিন্তু প্রগতিশীল কোন পরিবর্তন দেখা যায়নি।
প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে কার্ল মার্কসের ধারণাও ছিল একই ধরনের। তিনি বলেছেন যে, হিন্দুস্থানের সোনালী যুগে তিনি বিশ্বাস করেন না। তিনি প্রাক-ব্রিটিশ ভারতের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে “মর্যাদাহানিকর, স্থবির ও প্রগতিবিহীন” বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে ভারতের গ্রাম্য সমাজ ছিল “ক্ষুদ্র, আধা-বর্বর ও আধা-সভ্য সমাজ।

অর্থনৈতিক তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ হতে “সোনার বাংলা” একটি অলীক কল্পনা মাত্র, বাস্তবে এর অস্তিত্ব ছিল না। অবশ্য ঐতিহাসিকগণ অর্থনীতিবিদদের তাত্ত্বিক যুক্তি মানেন না। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে তত্ত্বের ভিত্তিতে নয়, বরং ঐতিহাসিক উপাদানের ভিত্তিতেই প্রকৃত ইতিহাস জানা সম্ভব। তাঁরা তাই ঠাট্টা করে বলেন: An economist is someone who takes something that works in
practice and wonders whether it will work in theory. (অর্থনীতিবিদ হলেন এমন ধরনের ব্যক্তি যিনি কোন কিছু বাস্তবে কাজ করছে দেখলেও তত্ত্ব অনুসারে তা কাজ করছে কি না তা নিয়ে মনে মনে উদ্বিগ্ন থাকেন।)
পক্ষান্তরে অর্থনীতিবিদগণ মনে করেন যে, তত্ত্ব ছাড়া কোন তথ্যের বিশ্লেষণ সম্ভব ধারাও এক ধরনের তত্ত্বে বিশ্বাস করেন। অর্থনীতিবিদ আলফ্রেড মার্শাল মনে করতেন। নয়। যারা দাবি করেন যে, তত্ত্ব ছাড়া শুধু উপাত্তের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব, যে, যাঁরা দাবি করেন যে, উপাত্তই ব্যাখ্যার জন্য যথেষ্ট, তাঁরা হচ্ছেন সব চেয়ে বেপরোয়া ও বিপজ্জনক তারিক ইতিহাসের ব্যাখ্যায় অর্থনৈতিক তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে বিতর্কের অবসান এখনও হয়নি, কোন দিন হবে কি না জানি না। তাই “সোনার বাংলা” সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হলে আমাদের ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ পর্যালোচনা করতে হবে। ভালভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, প্রচলিত ঐতিহাসিক উপাত্তসমূহের ব্যাখ্যা সহজ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই যা বলা হচ্ছে, তার উল্টোটিও সত্য।
“সোনার বাংলা” তত্ত্বের প্রবক্তারা মনে করেন যে, ব্রিটিশ শাসনের আগে বাংলাদেশে কখনও দুর্ভিক্ষ হয়নি। অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ কম হয়েছে, এ কথা হয়ত অনেকাংশে সত্যি । কিন্তু আদৌ দুর্ভিক্ষ হয়নি এ অনুমান ঠিক নয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্তত তিনটি দুর্ভিক্ষের অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। বাংলাদেশের প্রাচীনতম অভিলিখনে রয়েছে দুর্ভিক্ষের বর্ণনা। মহাস্থানলিপি সম্ভবত খৃষ্টের জন্মের দু’শ বছর আগে লিখিত হয়। দুজন ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত ব্রাহ্মী ভাষায় লিখিত অভিলেখের নিম্নরূপ ইংরাজি অনুবাদ করেছেন
To Gobardhana of the Samvamgiyas was granted by order (or To the Samvamgiyas was given by order sesamum and mustard seeds). The sumatra will cause it to be carried out from the prosperous city of Pundranagara (And likewise) will cause paddy to be granted to the Samvamgiyas. In order to tide over the outbreak of distress caused by flood (or fire or superhuman agency) and insect (lit. parrots) in the city, this granary and treasury will have to be replenished with paddy and Gandaka coins.
(সংবঙ্গীয়দের গোবর্ধনকে নির্দেশ দেওয়া হয় (অথবা আদেশ অনুসারে সংবঙ্গীয়দের তিল ও সর্ষে বীজ দেওয়া হয়)। সুমাত্র সমৃদ্ধশালী পুণ্ড্রনগর হতে এ আদেশ কার্যকর করবে। একই ভাবে সংবঙ্গীয়দের ধান দেওয়ার ব্যবস্থা করে বন্যা (অথবা অগ্নি ও অতিমানবিক কোন শক্তি) এবং পতঙ্গ (আক্ষরিক অর্থে তোতা পাখি) কর্তৃক সৃষ্ট দুর্দশা অতিক্রমণের জন্য। এই শস্যাগার ও রাজভাণ্ডারের শূন্যতা ধান্য ও গন্ধক মুদ্রায় পুনরায় পূরণ করা হবে।)
“সংবঙ্গীয়” শব্দের ব্যাখ্যা নিয়ে পণ্ডিতদের মতবিরোধ রয়েছে। কেউ বলেন সংবঙ্গীয় হল বৌদ্ধ সম্প্রদায়। অধিকাংশ পণ্ডিতরাই মনে করেন যে, সংবঙ্গীয় হল একটি জনগোষ্ঠী। সংবঙ্গীয় শব্দের অর্থ যাই হোক দৈব দুর্বিপাকের ক্ষেত্রে সরকারী সাহায্যের যে ব্যবস্থা মহাস্থান অভিলেখে উল্লেখিত হয়েছে সে সম্পর্কে কোন মতদ্বৈততা নেই। দ্বিতীয়ত, আনুমানিক নবম শতকে রচিত “মঞ্জুশ্রী মূলকল্প” গ্রন্থে গৌড়ের পূর্বাঞ্চলের প্রদেশসমূহে মহাদুর্ভিক্ষের উল্লেখ রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন যে এ দুর্ভিক্ষ চতুর্থ শতাব্দীতে ঘটে। আবার কেউ কেউ মনে করেন দুর্ভিক্ষটি সম্ভবত সপ্তম অথবা অষ্টম শতাব্দীতে ঘটেছিল।” তৃতীয় দুর্ভিক্ষের বর্ণনা রয়েছে “ফতিয়া ইবরিয়া” গ্রন্থে।
১৬৬১ হতে ১৬৬৩ খৃষ্টাব্দে এ দুর্ভিক্ষ ঘটে। দীর্ঘ দু’হাজার বছরে মাত্র তিনটি দুর্ভিক্ষের বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। এ তথ্যের ভিত্তিতে অবশ্যই যুক্তি দেখানো সম্ভব যে, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ ঘটলেও তা অতি কদাচিৎ ঘটেছে। কিন্তু এ যুক্তি দুটি কারণে গ্রহণযোগ্য নয় । ঐতিহাসিক আকর গ্রন্থসমূহ রচনা করেছেন সভাসদগণ। জনগণের আর্থিক অবস্থার প্রকৃত চিত্র তুলে করা তাদের লক্ষ্য ছিল না, তাঁরা তাঁদের প্রভুদের গুণকীর্তনে ব্যস্ত ছিলেন। তাই ঐতিহাসিক আকর গ্রন্থে জনগণের দুঃখ দুর্দশা চেপে যাওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে বেশির ভাগ দুর্ভিক্ষই অতি ক্ষুদ্র অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকত; সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ত না। তার কারণ হল বাংলাদেশে প্রধান প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিল বন্যা। বন্যায় সকল অঞ্চলে সমান ক্ষতি হয় না। যে সব অঞ্চল খরাপ্রধান, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সে সব অঞ্চলে শস্যহানি হয় ব্যাপক ৷ তাই খরাজনিত দুর্ভিক্ষ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়টি চাণক্যের দৃষ্টি এড়ায়নি । অর্থ শাস্ত্রে চাণকা তাই লিখেছেন, “অতিবৃষ্টির চেয়ে খরা অনেক খারাপ”।

” বন্যার ফলে আঞ্চলিক দুর্ভিক্ষ হত, কিন্তু সারা দেশে দুর্ভিক্ষ হত না। আঞ্চলিক খাদ্যাভাবের তথ্য সভাসদরা অনেক ক্ষেত্রে জানতেই পারত না। কাজেই এ ধরনের খাদ্যাভাবের বর্ণনা ইতিহাসের আকরগ্রন্থে নেই। অথচ তৎকালীন বাংলা সাহিত্যে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের অনেক বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা রয়েছে। অনাহারের বর্ণনা রয়েছে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম গ্রন্থ “চর্যাপদে” (আনুমানিক দশম হতে দ্বাদশ শতকে রচিত)। উদাহরণস্বরূপ নীচের শ্লোকটি স্মরণ করা যেতে পারে
টালিতে মোর ঘর নাহি পড়িবেশী
হাড়ীতে মোর ভাত নাহি নিতি আবেশী।
(টিলাতে মোর ঘর, প্রতিবেশী নেই। হাড়িতে ভাত নেই, নিতাই ভূষিত ) “সদুক্তিকর্ণামৃত” (তেরো শতকের প্রথম দিকে সংকলিত) গ্রন্থে অভাব অনটনের নিম্নরূপ বর্ণনা রয়েছে ” “শিশুরা ক্ষুধায় পীড়িত, দেহ শবের মত শীর্ণ, আত্মীয় স্বজনেরা মন্দাদর, পুরাতন ভগ্ন পাত্রে এক ফোঁটা মাত্র জল ধরে, গৃহিণীর পরিধানে শতচ্ছিন্ন বস্ত্ৰ ।” ষোল শতকের কবি জয়ানন্দ তাঁর “চৈতন্যমঙ্গল” গ্রন্থে একটি আঞ্চলিক দুর্ভিক্ষের নিম্নরূপ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন :
শ্রীহট্ট দেশে অনাচার দুর্ভিক্ষ জন্মিল
ঢাকা-চুরি অনাবৃষ্টি মড়ক লাগিল
উচ্ছন্ন হইল দেশ অরিষ্ট দেখিয়া
নানা দেশে সর্ব লোক গেল পালাইয়া ।
ময়মনসিংহের লোকগীতি মনুয়াতেও রয়েছে দুর্ভিক্ষের বর্ণনা
চান্দ বিনোদ আসি কয় মায়ের কাছে
“আশনা পানিতে মাও সব শস্যি গেছে।”
মায়ে কান্দে পুতে কান্দে সিরে দিয়ে হাত।
সারা বছরের লাগ্যা গেছে ঘরের ভাত ।
হাকায় দেড় আড়া ধান পইড়াছে আকাল
কি দিয়ে পালিবে মায় কুলের ছাওয়াল ।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য থেকে আকাল ও দারিদ্র্য সম্পর্কে এ ধরনের অজস্র উদ্ধৃতি দেওয়া সম্ভব। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে, প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাদেশে সব সময়েই আকাল ও দুর্ভিক্ষ লেগে থাকত। প্রকৃত পরিস্থিতি হল এই যে, প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় যখন ফসল ভাল হত তখন অধিকাংশ লোকই স্বচ্ছন্দে দিন কাটাত কিন্তু প্রায়ই বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্বিপাক দেখা দিত। এর ফলে কোন কোন অঞ্চলে কখনও কখনও দুর্ভিক্ষ বা আকাল দেখা দিত। এ সব আকালের সময় অনেক ক্ষেত্রে গরীবরা দেশের এক অঞ্চল হতে অন্য অঞ্চলে অভিবাসী হত।
তবে মাঝে মাঝে আকাল সত্ত্বেও বাংলার লোকেরা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সচ্ছল ছিল। বিশেষ করে উত্তর ভারতে উপর্যুপরি খরার ফলে অনেক ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হত। তুলনামূলকভাবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাতে দুর্ভিক্ষ সংঘটনের হার ও তীব্রতা ছিল অনেক কম। তবে সোনার বাংলাতে একেবারেই দুর্ভিক্ষ হয়নি এ ধরনের অনুমান আদৌ সঠিক নয়।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার আর্থিক সমৃদ্ধি সম্পর্কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হল বাংলায় বিস্ময়কর কম দাম সম্পর্কে বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ। চতুর্দশ শতকে মরক্কোর পর্যটক ইবনে বক্তৃতা লিখেছেন, “পৃথিবীতে আর কোথাও এত সস্তা দাম দেখিনি।” চীনা পর্যটক ওয়াং তু ওয়ান চৌদ্দ শতকে বাংলায় এসেছিলেন। তাঁর মতে বাংলায় জিনিসের দাম সস্তা ছিল। সপ্তদশ শতকে অনুরূপ বিবরণ লিখেছেন সিবাস্তিয়ান ম্যানরিক ও ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের।
আপাতদৃষ্টিতে বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ সম্পূর্ণ সত্য মনে হয়। তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় কয়েকটি দুর্বলতা রয়েছে। বিদেশী পর্যটকদের আয় ছিল বাংলাদেশের সাধারণ লোকদের তুলনায় অনেক বেশি। বিদেশী পর্যটকরা সোনার ও রূপার দিনারে জিনিষের দাম হিসেব করেছেন। কিন্তু প্রাচীন মধ্যযুগের বাংলাতে সাধারণ লোকদের বিনিময়ের মাধ্যম স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রা ছিল না। সাধারণ লোকেরা পণ্য কিনত ও বিক্রয় করত কড়িতে। যারা সোনার ও রূপার দিনারে আয় করত তাদের কাছে কড়িতে কেনা পণ্য সস্তাই মনে হবে। কিন্তু যারা কড়িতে জায় করত তাদের কাছে এ সব পণ্যের মূল্য সত্তা মনে হত না।

উদাহরণস্বরূপ ইবনে বতুতার ভ্রমণ বৃত্তান্ত স্মরণ করা যায়। বাংলাদেশে জিনিষপত্রের নাম সম্পর্কে তিনি লিখেছেনঃ
এ আমি আট দিরহামে আটটি ভাজা মোরগ বিক্রয় হতে দেখেছি। এক দিরহামে পনেরটি কচি কবুতর পাওয়া যেত, দুই দিরহামে পাওয়া যেত একটি মোটাসোটা ভেড়া। আমি আর দেখেছি, ত্রিশ হাত লম্বা সর্বোত্তম মানের মিহি তুলার কাপড় দু’ দিনারে বিক্রয় হয়েছে, সুন্দরী ক্রীতদাসী বিক্রয় হয়েছে এক লিনারে, যা মরক্কোর মূল্যে আড়াই দিনারের সমান।
ইবনে বতুতার বর্ণনা সম্পর্কে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, ইবনে বতুতা যখন দ্রব্যমূল্যের উল্লেখ করেছেন তখন তিনি দিনারে ও দিরহামে দাম হিসাব করেছেন। অর্থ ইবনে বক্তৃতা নিজেই লিখেছেন যে বাংলায় কড়ি মুদ্রা হিসাবে ব্যবহৃত হত। দ্বিতীয়ত, ইবনে বক্তৃতা ছিলেন উচ্চ-বর্গের লোক। সাধারণ লোকের তুলনায় তাঁর আয় ছিল অনেক বেশি।
দিল্লীর সুলতান ইবনে বতুতাকে বছরে সতের হাজার দিনার ভাতা দিতেন।ঋণ শোধ করার জন্য সুলতান ইবনে বতুতাকে পঞ্চান্ন হাজার দিনার দেন। প্রথমবার সালাম জানাতে গেলে দিল্লীর উজির তাঁকে দুই হাজার রৌপ্যমুদ্রা উপহার দেন। কাজেই বাংলার লোকদের তুলনায় ইবনে বতুতার আয় ছিল অনেক বেশি। তাঁর কাছে দ্রব্যমূল্য সন্তা মনে হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। তৃতীয়ত, ইবনে বক্তৃতা নিজেই বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর কাছে জিনিষের দাম সস্তা মনে হলেও সাধারণ লোকের কাছে সস্তা মনে হত না। তাই ইবনে বতুতা লিখেছেন, “আমি তাদের বলতে শুনেছি, এ দামও তাদের জন্য বেশি।
মধ্যযুগের বাংলায় দ্রব্যমূল্য সস্তা হওয়ার একটি অত্যন্ত করুণ দিকও রয়েছে। দ্রব্যমূল্য নির্ভর করে জনগণের আয়ের উপর। জনগণের আয় যখন কমে যায় তখন দ্রব্যমূল্যও কমে যায় । তাই অত্যাচারী শাসকদের রাজত্বকালে দ্রব্যমূল্য কমে যেত কেননা, অত্যাচারী শাসকরা জনগণের কাছ থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করার ফলে জনগণের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেত। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক হ্রাস অর্থনীতির সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, বরং উদ্বেগের কারণ। প্রসঙ্গক্রমে শায়েস্তা খানের রাজত্বকালে দ্রব্যমূল্যের স্বল্পতা সম্পর্কে কিংবদন্তি স্মরণ করা যেতে পারে।
জনশ্রুতি অনুসারে শায়েস্তা খানের রাজত্বকালে টাকায় আট মণ চাল বিক্রি হত। এ সাফল্যে গর্বিত হয়ে তিনি লালবাগ কেল্লাতে একটি তোরণ নির্মাণ করে এর দুয়ার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নির্দেশ দিয়েছিলেন, যদি কোন শাসক চালের দাম টাকায় আট মণের পর্যায়ে কমিয়ে আনতে পারে তবেই এ তোরণ খোলা যাবে। সকল ঐতিহাসিকরা এ ঘটনাকে শায়েস্তা খানের আমলে বাংলার সমৃদ্ধির অকাট্য প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু শায়েস্তা খানের আমলে চালের দাম হঠাৎ কমে এল কেন তার কোন সদুত্তর তাঁরা দিতে পারেন না।
অর্থনীতির সূত্র অনুসারে দাম কমতে পারে সরবরাহ বৃদ্ধির অথবা চাহিদা হ্রাসের ফলে। আকস্মিকভাবে শায়েস্তা খানের আমলে চালের সরবরাহ বৃদ্ধির কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখা যাচ্ছে না। তাই চাহিদা হ্রাসের সম্ভাবনাই বেশি। চাহিদা হ্রাসের একটি ‘বড় কারণ হতে পারে, লোকের আয় কমে যাওয়া। প্রাপ্ত ঐতিহাসিক উপাদান থেকে এ অনুমানটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়। দেখা যাচ্ছে যে, শায়েস্তা খান তাঁর শাসনকালে রাজস্ব আদায় বাড়ানোতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছিলেন। নিয়মিত খাজনার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করে তিনি দিল্লীর বাদশাকে নজরানা দিয়েছেন। নিজের জন্যও জমিয়েছেন অনেক টাকা।
একটি হিসাব হতে দেখা যাচ্ছে যে, শায়েস্তা খানের শাসনকালে মোট জাতীয় উৎপাদের ৪৩.৮ শতাংশ থেকে ৬৪ শতাংশ রাজস্ব হিসাবে সংগ্রহ করা হয়েছে। এত উঁচু হারে রাজস্ব সংগ্রহের ফলে লোকের ক্রয়ক্ষমতা সীমিত হয়ে পড়ে। এর ফলে দ্রব্যমূল্য হ্রাস পাওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক। এ ধরনের পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্য নীচু পর্যায়ে থাকা জনগণের জন্য আশীর্বাদ নয় বরং অভিশাপ।
যে কোন বক্তব্য পরীক্ষা করতে হলে প্রবক্তাগণ কি বলেছেন তা বিবেচনা করাই যথেষ্ট নয়, তারা কি বলেননি তাও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। সোনার বাংলার প্রবক্তাগণ বার বার জোর দিয়ে বলছেন যে, বাংলা শুধু অর্থনৈতিক দিক দিয়েই সমৃদ্ধ ছিল বাংলায় দারিদ্র্য ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। কিন্তু এ প্রসঙ্গে তাঁরা বাংলায় মজুরির হার ও দাসত্ব সম্পর্কে আদৌ কোন তথ্য তুলে ধরেননি।
প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় শ্রমিকদের মজুরি সম্পর্কে প্রাপ্ত উপাত্ত অপ্রতুল। তবে কিংবদন্তি-খ্যাত মসলিনের তাতিদের সম্পর্কে যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা হতে এ সিদ্ধান্ত অস্বীকার মোটেও সম্ভব নয় যে তাঁতিদের মজুরির হার ছিল অত্যন্ত কম। মসলিন ব্যবসায়ে তাঁতিরা লাভবান হত না। লাভ করত বিদেশী ফড়িয়ারা, তাদের দালালরা এবং সরকারী কর্মকর্তারা। আঠারো শতকের শেষ দিকে জন টেলর ঢাকায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আবাসিক প্রতিনিধি ছিলেন।
তিনি লিখেছেন যে, মসলিনের দামের কমপক্ষে শতকরা বিশ ভাগ মুগল কর্মকর্তাদের কমিশন হিসাবে দিতে হত। নগণ্য মজুরির বিনিময়ে মসলিন। উৎপাদনের জন্য শাসকরা তাঁতিদের বাধ্য করত। ফরাসী লেখক আবে রায়নালও বলেছেন যে, বাংলায় দক্ষ তাঁতি হওয়া ছিল দুর্ভাগ্যের লক্ষণ, কারণ তাদের স্বল্প মজুরির বিনিময়ে কাজ করতে হত। কাজেই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, হিন্দু তাঁতিদের সবচেয়ে নীচু বর্ণে স্থান দেওয়া হয়েছে। মুসলমান তাঁতিদের অবজ্ঞাভরে বলা হত জোলা (যার অর্থ হচ্ছে বোকা)।
হিসাব করে দেখা গেছে যে, একখণ্ড মসলিন তৈরির মজুরি বড় জোর এক দিনার ছিল। অথচ একখণ্ড মসলিন তৈরির জন্য একজন ওস্তাদ তাঁতি একজন সহকারী ও একজন শিক্ষানবিসের এক বছর সময় লাগত । শিক্ষানবিস কোন মজুরি পেত না।সহকারী তাঁতি ওস্তাদ তাঁতির আয়ের ২৫ হতে ৫০ শতাংশ পেত। মধ্যযুগে মসলিনের একজন ওস্তাদ তাঁতির বার্ষিক মজুরি দিয়ে খুব বেশি হলে ৫৭.৮ মণ হতে ৭০ মণ চাল কেনা যেত। সহকারী তাঁতি বছরে যে মজুরি পেত তা দিয়ে ১৭.৫ হতে ২৯.৭ মণ চাল কেনা সম্ভব ছিল। আঠার শতকের মধ্য ভাগে তাঁতিদের আয় আরও কমে আসে।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে যে, ১৭৫১-৫২ সালে তাঁতিরা বছরে ১৩.৬ হতে ৩২.৭ মণ চালের সমপরিমাণ মজুরি অর্জন করত। ১৭৩৫ সালের একটি প্রতিবেদন হতে দেখা যায় যে, ফরাসী শ্রমিকদের মজুরির হার ভারতীয় শ্রমিকদের মজুরির ছয় গুণ ছিল। শুধু মান ও সৌন্দর্যের জন্যই নয়, মূল্যের দিক দিয়েও মসলিন ছিল আকর্ষণীয়। কিন্তু আজকের তৈরি পোষাক শিল্পের মত মসলিনশিল্পেরও তুলনামূলক সুবিধা (comparative advantage) ছিল শ্রমের নিম্ন মজুরি। যদি মসলিনশিল্পে মজুরি এত কম হয় তবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও মজুরির হার নীচু হওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক, অন্যথায় মসলিন শ্রমিকরা অন্য পেশাতে চলে যেত।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের সবচেয়ে স্পষ্ট নিদর্শন হল দাস-প্রথার প্রচলন। অনেক ঐতিহাসিক জোর গলায় দাবি করেন যে, বাংলায় বিদেশী নাগরিকদের দাস হিসাবে বিক্রয় করা হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় নাগরিকদের দাস হিসাবে বিক্রয় করা হয়নি। এ অনুমানের কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এদেশে দাসপ্রথা প্রাচীনকাল হতে চালু ছিল। আইনত জীমূতবাহন (আনুমানিক দ্বাদশ শতক) দাসব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত নির্দেশ লিপিবদ্ধ করেছেন।
বিদেশী ভ্রমণকারীরা দাসপ্রথার প্রচলন ল করেছেন। চৌদ্দ শতকে বাংলা ভ্রমণ করে ইবনে বতুতা লিখেছেন, “আমি শয্যাভূষণ ক্রীতদাসীদের এক দিনার অর্থাৎ মরক্কোর আড়াই দিনারে বিক্রয় হতে দেখেছি। আমি ঐ দামে আশুরা নামে একজন ক্রীতদাসী ক্রয় করেছিলাম। মেয়েটি ছিল অপরূপ সুন্দরী। আমার একজন সহযাত্রী দুই দিনার দিয়ে একজন দাস বালক ক্রয় করেছিল। পর্তুগীজ ব্যবসায়ী বারবোসা ষোল শতকে দাস ব্যবসায়ের বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।

সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন যে, সিলেট ও ঘোড়াঘাট অঞ্চল থেকে অনেক খোজা সরবরাহ করা হত। সম্রাট জাহাঙ্গীর তাঁর আত্মজীবনীতে বাংলার দাসপ্রথা সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। মধ্যযুগের বাংলায় পিতামাতা কর্তৃক কন্যা সন্তান বিক্রয় ছিল নিতান্ত মামুলি ঘটনা। উদাহরণস্বরূপ, “চৈতন্য চরিতামৃত”-এর নিম্নোক্ত শ্লোক স্মরণ করা যেতে পারে:
নাহা লুহা লবণ বেচিবে ব্রাহ্মণে
কন্যা বেচিবেক যে সর্ব শাস্ত্র জানে।
তবে বাংলায় দাসপ্রথার প্রচলন সম্পর্কে প্রমাণ শুধু ঐতিহাসিক আকরগ্রন্থ ও তৎকালীন সাহিত্যে সীমাবদ্ধ নয়। দাস ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কে প্রচুর দলিল পাওয়া গেছে। চন্দননগরে ফরাসী শাসকদের মহাফেজখানায় দাস বিক্রয়ের কমপক্ষে এক শ’ দলিল পাওয়া গেছে। দাস বিক্রয়ের দলিল পাওয়া গেছে সিলেটে, হুগলী জেলায় এবং ত্রিপুরা রাজ্যে। কলকাতা যাদুঘরে রক্ষিত একটি দলিলে দেখা যায় যে কায়স্থ পাড়া গ্রামের জনৈক গোপীনাথ মজুমদার ১৬৬৮ খৃষ্টাব্দে নিজেকে ইসিন্দর খানের কাছে আর্থিক দুরবস্থার জন্য বিক্রয় করেছে।
শায়েস্তা খানের শাসনামলকে বাংলার ইতিহাসের স্বর্ণযুগ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে । অথচ শায়েস্তা খানের রাজত্বকালেই দুর্দশাগ্রস্ত ব্যক্তি নিজেকে দাস হিসাবে বিক্রয় করেছে। দাস বিক্রয়ের অনেক দলিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে রয়েছে ।” দাস বিক্রয়ের যে সব দলিল পাওয়া গেছে তাতে এ কথা সুস্পষ্ট যে, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মত বাংলাতেও দাস প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে প্রাক্-ব্রিটিশ আমলে বাংলার জনসংখ্যার কত শতাংশ দাস ছিল তার হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রতিবেশী আসামে দাস, ভূমিদাস ও বন্ধকি দাসরা জনসংখ্যার ৫ শতাংশ হতে ৯ শতাংশ ছিল বলে অনুমান করা হচ্ছে। আসামে আনুপাতিক হারে বাংলার চেয়ে দাস বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে । তাই কোন পর্যায়েই বাংলাদেশে দাসের সংখ্যা ৫ শতাংশের বেশি ছিল না, তার অনেক কম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে দাস সংক্রান্ত দলিলগুলো হতে দেখা যাচ্ছে, দাসদের বিক্রয়মূল্য ছিল কম। মজুরির হার কম হওয়ার অনুমানের সাথে এ তথ্য সঙ্গতিপূর্ণ। অর্থনৈতিক তত্ত্ব অনুসারে দাসের মূল্য হল একজন দাস সারা জীবন ধরে যা আয় করবে তার বর্তমান মূল্য । দাসদের আয় নির্ভর করে মজুরির উপর। তাই নজুরির হার কম হলে দাসের দামও কম হবে।
উপরোক্ত আলোচনা হতে একথা সুস্পষ্ট যে প্রাক-ব্রিটিশ বাংলা স্বপ্নরাজ্য ছিল না। অন্যান্য প্রাক-শিল্প-বিপ্লব সমাজের মত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিও ছিল ক্ষণ তাই প্রশ্ন ওঠে যে, প্রাক্-ব্রিটিশ বাংলার অর্থনীতির সুস্পষ্ট সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কেন সোনার বাংলার কিংবদন্তি এত দিন ধরে চালু রয়েছে? এর দুটি কারণ রয়েছে, প্রথমত, ইতিহাসের আকরসমূহে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার সমৃদ্ধি সম্বন্ধে ঐকমত্য রয়েছে। বাংলার সম্বন্ধে কিংবদন্তি প্রচার করেছেন বিদেশী পর্যটকরা। এরা ছিলেন শিক্ষিত, বুদ্ধিমান ও ওয়াকিবহাল। তবে পর্যটকদের সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।
সাধারণত বৈদেশিক পর্যটক দারিদ্র্যের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারে না। এ সম্পর্কে পল্লী উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ রা চেম্বারের বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে।” রবার্ট চেম্বার লিখেছেন যে, বিদেশ বিশেষজ্ঞরা উন্নয়নশীল দেশের দারিদ্র্যের যথার্থ মূল্যায়ন করতে পারেন না। তার করণ হল পর্যটকরা সাধারণত সবচেয়ে ভাল মওসুমে সফর করে। তারা বড় বড় শহরে রাজ দিয়ে চলাফেরা করে। তারা মেলামেশা করে স্থানীয় অভিজাতদের সাথে। দরিদ্ররা থাকে শহর থেকে দূরে যেখানে অনেক সময় আদৌ কোন রাস্তা নেই। মওসুম ভেদে দারিদ্র্য বাড়ে ও কমে। কাজেই বাইরের পর্যটকদের পক্ষে দারিদ্র্যের বিভীষিকা অনুধাবন কর সম্ভব হয় না।
দ্বিতীয়ত, যখন কেউ বাংলার সমৃদ্ধির বর্ণনা করেন, তখন তাদের মনে একট তুলনামূলক চিত্র থাকে। যদিও প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাতে দারিদ্র্য সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল না তবু বাংলাদেশ ভারতের ও এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চল থেকে সমৃদ্ধশালী ছিল। তার একটি বড় কারণ হল যে, এখানে খরার প্রভাব ছিল সীমিত। সকল সীমাবন্ধা সত্ত্বেও, সমকালীন অন্যান্য সমাজের তুলনায় প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলায় দারিদ্রের তীব্রতা ছিল অনেক কম।
প্রকৃতপক্ষে এ সমাজে দারিদ্র্য ও সমৃদ্ধি পাশাপাশি বিরাজ করত। যখন ফসল ভাল হত তখন সবাই ভালভাবে জীবন কাটাতে পারত। তবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিলে অনেকেই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ত। উপরন্তু সম্পদের অসম বণ্টনের ফলে এ সমাজে দীর্ঘস্থায়ী দারিদ্র্যের গহ্বর ছিল। দাস প্রথার প্রচলন থেকে প্রতীয়মান হয় যে, এ সমাজে অনেক জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিকভাবে অসুবিধাজনক অবস্থায় ছিল। তারা বার-বার দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছে।
বিপক্ষে যত জোরালো ঐতিহাসিক সাক্ষ্য অথবা অকাট্য অর্থনৈতিক বিশ্লেষণই উপস্থাপন করা হোক না কেন, বাঙ্গালীর মনোজগত হতে সোনার বাংলার কিংবদন্তি অতি সহজে অপসৃত হবে না। যার যা নেই, তাই সে খুঁজে বেড়ায় এ কথা শুধু ব্যক্তির ক্ষেত্রেই নয়, জাতির ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসী হচ্ছে অভিবাসীদের বংশধর। তাই তারা তাদের পিতৃপুরুষের পরিচয় জানে না। বিই অর্জন করলেই তারা পূর্ব-পুরুষের পরিচয় খুঁজে বেড়ায়। আবার ফরাসী দেশে নরনারীর সম্পর্ক অত্যন্ত শিথিল । অভিজাত বংশের ছেলেমেয়েদের পিতৃত্ব নিয়ে প্রায়ই কানাঘুষ শোনা যায়। মার্কিন লেখক মার্ক টোয়েন ঠাট্টা করে লিখেছেন, মার্কিনরা বিত্তবান হলে পিতৃপুরুষের অনুসন্ধান করে, ফরাসীদের পয়সা হলে তারা তাদের পিতৃপরিচয় খুঁজে যায়। বাঙ্গালীদের পিতা বা পিতামহের পরিচয়ের সমস্যা নেই। সমস্যা হল বিত্তের। দিন পর্যন্ত দারিদ্র্যের নির্মম কশাঘাতে তারা জর্জরিত হবে, ততদিন পর্যন্ত বাঙ্গালীরা তীতের ইতিহাসে এবং পরকালে সান্ত্বনা খুঁজে বেড়াবে।
আরও দেখুনঃ